আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে দিনটিকে ভালোবাসা দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হলেও সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলের মানুষেরা দিনটিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ হিসেবে পালন করেন। সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) বন। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে খুলনাসহ উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দুই দশক ধরে দিনটি পালিত হয়ে আসছে।
২০০১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রূপান্তর ও পরশের উদ্যোগে এবং দেশের আরও ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়। সে হিসেবে এবার পালিত হচ্ছে ২৪তম সুন্দরবন দিবস।
সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার খান সাহেব কমরউদ্দিন ডিগ্রি কলেজর অধ্যক্ষ চয়ন কুমার রায় বলেন, ‘সুন্দরবনের টিকে থাকার ওপর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সমৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভরশীল। এটা রক্ষা করতে না পারলে আমাদের দেশ একটা বিরাট সংকটের সম্মুখীন হবে। তাই সবার আগে সুন্দরবনকে ভালোবাসতেই হবে। “বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালোবাসুন” এই প্রতিপাদ্যে প্রতিবছর উপকূলীয় এলাকায় সুন্দরবন দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে সুন্দরবন দিবস।’
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ‘আমরা যারা সুন্দরবনের পাশের এলাকার মানুষ, তাদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এই সুন্দরবন না থাকলে বিভিন্ন দুর্যোগে কয়রা উপজেলার নাম নিশানা এত দিন মুছে যেত। আমরা সুন্দরবনের অনেক ক্ষতি করলেও সুন্দরবন সব সময় শুধুই দিয়েই গেছে, বিনিময়ে সে পায়নি কিছুই। আমরা বলতে চাই, যারা বুঝে বা না বুঝে সুন্দরবনের ক্ষতি সাধন করে আসছে, তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকেই রুখে দাঁড়াতে হবে।’
বন বিভাগ সূত্র বলছে, বাংলাদেশ অংশের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনে এখন বাঘশুমারি চলছে, যা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এবার শুমারিতে বাঘের সংখ্যা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে ২০২৩ সালের শুমারি অনুযায়ী, বনে চিত্রা হরিণ, বন্য শূকর ও বানরের সংখ্যা বেড়েছে। বনে ২০০৪ সালে চিত্রা হরিণ ছিল ৮৩ হাজার, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টিতে। বন্য শূকর ২০০৪ সালে ছিল ২৮ হাজার, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৫১৫টিতে। ২০০৪ সালে বানর ছিল ৫১ হাজার, ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৪৪টিতে। এ ছাড়া বর্তমানে বনে গুইসাপ রয়েছে ২৫ হাজার ১২৪টি ও শজারু ১২ হাজার ২৪১টি। ২০২৩ সালের আগে কখনো এ দুটি প্রাণীর শুমারি হয়নি। তবে আশির দশকে মায়া হরিণ ছিল ২ হাজার ২৬৫টি, ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৮৭টিতে। ১৯৯৫ সালে বনের নদীতে কুমির ছিল ১৫০ থেকে ২০০টি, ২০১৬ সালের জরিপে কুমিরের সংখ্যা দেখানো হয় ১৫০ থেকে ২০৫টি। তবে কমেছে দুই প্রজাতির ডলফিন। ২০০৬ সালে বনের নদীতে ছিল ৪৫১টি ইরাবতী ডলফিন ও ২২৫টি শুশুক। ২০১৯ সালে কমে দাঁড়ায় ইরাবতী ডলফিন ১১৩টি ও শুশুক ১১৮টি।
সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার মঠবাড়ী এলাকার বাসিন্দা আবু সাঈদ বলেন, ‘এখন আমাদের সুন্দরবনের পাশের নদীতেও সেভাবে মাছ পাওয়া যায় না। মুনাফালোভীরা সুন্দরবনকে ধ্বংস করার জন্য বিষ দিয়ে প্রাণী হত্যা করছে। বিষ দিয়ে মাছ ধরার বিষক্রিয়ায় শূকর, বাঘ ও অন্যান্য প্রাণী হুমকির মুখে পড়ে। এখন সুন্দরবনে সুন্দরীগাছ তেমন নেই। সেখানে গরান, গেওয়া, কেওড়া বাড়ছে। গোলপাতা আহরণকারীরা ৫০০ মণের অনুমতি নিয়ে কয়েক হাজার মণ পাতা কাটে। আমরা স্থানীয় বাসিন্দাদের এসব বিষয়ে সুন্দরবন দিবসে সচেতন করতে চাই।’
সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, সুন্দরবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ সমগ্র দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দুই কোটি মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থাও সুন্দরবনের ওপর কম-বেশি নির্ভরশীল। তাই যেকোনো মূল্যে আমাদের প্রাকৃতিক এই সুরক্ষাদেয়ালকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো