ডায়াবেটিস রোগীরা যারা নিরাপদে রোজা রাখতে চান তাদের ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত এবং রমজানের কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ আগে প্রস্তুত করা উচিত। এ পূর্বপ্রস্তুতির প্রথম অংশ হচ্ছে Pre Ramadan Assesment বা রমজান পূর্বক স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ।
এ সময় একজন চিকিৎসক একজন ডায়াবেটিসের রোগীর সব রোগ ইতিহাস, ডায়াবেটিসের ধরন, ডায়াবেটিসের ওষুধ ও এর প্রকারভেদ, ডায়াবেটিসের জটিলতা ইত্যাদি যাচাই করেন এবং সেই ডায়াবেটিসের রোগীর নিরাপদ রোজা পালনের সক্ষমতা বা অক্ষমতা বা নিরাপদ চিহ্নকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিভাজন করে থাকেন। যেমন-কম ঝুঁকি, মধ্যম মাত্রার ঝুঁকি বা অধিক মাত্রার ঝুঁকি। ঝুঁকির প্রকারভেদ নিরিখে একজন চিকিৎসক তার রোগীকে রোগীর রোজা পালনের সক্ষমতা বা অক্ষমতা ও জটিলতা বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
তারপরও অধিক ঝুঁকির ডায়াবেটিসের রোগীরাও কী রোজা পালনে যদি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকেন, তবে প্রত্যেক চিকিৎসক তার নিরাপদে রোজা পালনের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সব ক্যাটাগরির রোগীর জন্যই প্রত্যেক চিকিৎসকের একটি পূর্বপ্রস্তুতি, পরিকল্পনা করে থাকেন, যেমন-রোগীর খাদ্য তালিকা পুনর্বিন্যাস, রমজানে ডায়াবেটিসের ওষুধ মাত্রা নির্ধারণ ও গ্রহণের পুনর্বিন্যাস। রোজা পালন অবস্থায় বাড়িতেই গ্লুকোমিটারের মাধ্যমে রক্তে সুগারের মাত্রা পর্যবেক্ষণ, রমজানে ব্যায়াম সংক্রান্ত পরামর্শ।
রোজা পালন অবস্থায় নানা রকম জটিলতার পুনর্বিন্যাস ও করণীয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান প্রদান ইত্যাদি। অনেক মুসলিম ডায়াবেটিস রোগীদের মনে একটি অমূলক বা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, রোজা পালন অবস্থায় গ্লুকোমিটারের সুগার চেক করলে রোজা ভেঙে যাবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্বের সব বিজ্ঞ ইসলামিবিদদের মতে নিরাপদে ও সুস্থভাবে রোজা পালনে রক্তে সুগার চেক করা যেতে পারে। এতে রোজা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
কখন করবেন রক্তের সুগার পরীক্ষা
রোজা পালন অবস্থায় কখন কখন রক্তের সুগার পরীক্ষা করবেন তা নির্ভর করে প্রত্যেক রোগী কী ধরনের ডায়াবেটিসের ওষুধ সেবন করছেন তার ওপর। যেসব রোগী ইনসুলিন বা সালফোনাইল ইউরিয়া গ্রুপের ওষুধ সেবন করছেন তাদের ক্ষেত্রে দিনের একাধিক সময়ে রক্তে সুগার চেক করার প্রয়োজন হয়। এছাড়া দিনের যে কোনো সময়ে কোনো ব্যক্তির যদি হাইপো বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে সুগার কমে বা বেড়ে যাওয়ার যে কোনো লক্ষণ অনুভূতি হয় বা অন্যান্য যে কোনো শারীরিক অসুস্থতার সময় দিনে একাধিক বার রক্তে সুগার চেক করতে হবে এবং প্রয়োজনে রোজা ভেঙে ফেলতে হতে পারে। বেশিভাগ সময়ই একজন চিকিৎসক ডায়াবেটিসের রোগীদের নিম্নলিখিত সময়গুলোয় গ্লুকোমিটারের রক্তের সুগার চেক করার পরামর্শ প্রদান করে থাকেন তা হল- সেহরির আগে, সকালে (সেহরির ৪-৬ ঘণ্টা পর), মধ্য দুপুরে (বেলা ১১-১২টার মধ্যে), মধ্য অপরাহ্নে (দুপুর ২টার মধ্যে), ইফতারের আগে (ইফতারের ১-২ ঘণ্টা আগে), অথবা যে কোনো শারীরিক অসুস্থতার সময় তাৎক্ষণিকভাবে বা হাইপো বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা শরীরের রক্তে সুগার কমে বা বেড়ে যাওয়ার যে কোনো লক্ষণ অনুভূত হলে।
খাদ্য তালিকার পুনর্বিন্যাস
রমজান মাসে অতিভোজন বা অতিরিক্ত তেল, মসলাদার, ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। রমজানের আগেই একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী একটি সুষম খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক ডায়াবেটিস রোগীকে এসব মেনে চলতে হবে-
▶ ক্যালরি মেপে সেহরি, ইফতার ও ডিনার বা নৈশকালীন আহার সমন্বয় করতে হবে।
▶ প্রত্যেক বেলার আহারে কম শর্করাযুক্ত ও উচ্চ আশযুক্ত খাবারের সমন্বয় রাখতে হবে।
▶ খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল, সবজি বা সালাদ থাকতে হবে।
▶ অতিরিক্ত মসলাদার, ভাজাপোড়া, মিষ্টান্ন, বা মিষ্টি জাতীয় তরল বা শরবত এড়িয়ে চলতে হবে।
▶ ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি বা তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।
রোজাকালীন ব্যায়াম
রোজা রাখা অবস্থায় অতিরিক্ত শারীরিক ব্যায়াম না করাই শ্রেয়। বিশেষ করে মধ্য দুপুর থেকে ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত। কারণ এতে পানিশূন্যতা অথবা হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি বাড়ে। রোজা পালন অবস্থায় সব স্বাভাবিক কার্য পালন সম্ভব। নামাজ পালন করলে আলাদা করে ব্যায়ামের প্রয়োজন নেই। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইফতারের পর নির্দেশিতভাবে হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করা যেতে পারে।
ডায়াবেটিসের ওষুধ সমন্বয়
রমজান মাসে দৈনন্দিন রুটিনে অনেক পরিবর্তন আসে, যেমন-খাদ্য গ্রহণের সময় পরিবর্তন, খাদ্যের ধরন পরিবর্তন ইত্যাদি। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ বা অস্বাস্থ্যকর ও অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ, বাড়াতে পারেন, রোজাকালীন হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা ইফতারের পর হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি পাড়াতে পারে। যে কোনো ধরনের ঝুঁকি এড়াতে রমজানের আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সুষম খাদ্য তালিকা মেনে চলতে হবে। এ সময় একজন চিকিৎসক প্রত্যেক রোগীর ওষুধের মাত্রা ও ওষুধ গ্রহণের সময়কাল ও প্রয়োজনে ওষুধের ধরন পুনর্নির্ধারণ করে থাকেন।
* কখন রোজা ভেঙে ফেলতে হবে
প্রত্যেক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিই রক্তে শর্করা কমে বা বেড়ে যাওয়ার লক্ষণগুলো সম্বন্ধে সম্যক ধারণা থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একজন চিকিৎসক তার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের নিম্নলিখিত অবস্থায় রোজা ভেঙে ফেলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
▶ যদি রক্তে সুগারের মাত্রা <৭০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার বা <৩.৯ মিলিমোল/লিটার হয়।
▶ যদি রক্তে সুগারের মাত্রা >৩০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার বা >১৬.৬ মিলিমোল/লিটার হয়।
▶ রোজাপালনকালীন অবস্থায় রক্তে সুগার কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে (যেমন-বুক ধড়ফড়, হাত-পা কাঁপা, খিঁচুনি অতিরিক্ত স্বরে আওয়াজ, অবাদগ্রস্ততা ইত্যাদি) বা বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে (যেমন-অতিরিক্ত পানি পিপাসা, অতিরিক্ত ক্ষুধা, অবসাদগ্রস্ততা, অতিরিক্ত প্রস্রাব, বমি ভাব বা বমি, তীব্র পেটব্যথা ইত্যাদি) অথবা পানিশূন্যতা দেখা দিলে, এমনকি অন্য যে কোনো তীব্র শারীরিক অসুস্থতার সময়।
রমজানে নিরাপদে রোজা নিশ্চিত করার জন্য একটি গঠনমূলক পূর্বপ্রস্তুতি, স্বাস্থ্য সচেতনতা, সার্বজনীন সমন্বয় সাধনমূলক চিকিৎসা পরামর্শের ভূমিকা অপরিসীম। আসন্ন রমজানের আগেই আপনি প্রস্তুতি নিন ও নিরাপদে রোজা পালন করুন
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হরমোন ও ডায়াবেটিস বিভাগ, মার্কস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মিরপুর-১৪, ঢাকা।