মিঠু প্রথম আলোকে বলেন, মেট্রোরেলে পল্লবী থেকে মতিঝিল যেতে তাঁর সময় লাগে ২৬ থেকে ২৭ মিনিট। আগে বাসে যেতে সময় লাগত দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা।
মিঠুর মতো অনেক নিয়মিত যাত্রীই এখন বাসে চলাচল বাদ দিয়েছেন। তাঁরা বেছে নিয়েছেন মেট্রোরেল। এ কারণে মিরপুর-মতিঝিল পথে বাসে যাত্রী কমেছে। আয় কমেছে মালিক ও শ্রমিকের।
পরিবহনমালিক, শ্রমিক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিরপুর থেকে আগারগাঁও, ফার্মগেট হয়ে গুলিস্তান-মতিঝিল পথে চলাচলকারী বিহঙ্গ পরিবহন, শিকড় পরিবহন, বিকল্প পরিবহন, হিমাচল পরিবহন ও স্বাধীন পরিবহনে বেশি দূরত্বের যাত্রীরা কম উঠছেন। তবে বাসের সংখ্যা তেমন একটা কমেনি।
অবশ্য বাসে ভাড়া নির্ধারণের সময় যাত্রী ধরা হয় আসনের ৯৫ শতাংশ, যদিও মেট্রোরেল চালুর আগে গাদাগাদি করে যাত্রী নেওয়া হতো। বাসগুলো মেরামতে (রেনোভেশন) উচ্চ ব্যয় দেখানো হয়। কিন্তু বাস চলে লক্কড়ঝক্কড় অবস্থায়।
মিরপুর থেকে মতিঝিল ও যাত্রাবাড়ী পথে চলাচলকারী বাসগুলো যাত্রা শুরু করে পল্লবী বাসস্ট্যান্ড থেকে। গতকাল রোববার বেলা ১১টায় সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কিছু দূর পরপর একাধিক কোম্পানির বাস দাঁড়ানো। চালকের সহকারীরা যাত্রী তোলার জন্য হাঁকডাক দিচ্ছেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও সেভাবে যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না।
মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে শিকড় পরিবহনের বাসগুলোর তত্ত্বাবধান করেন লিয়াকত আলী খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মেট্রোরেলের তো অনেক সুবিধা। নিচের সড়কে তো সেভাবে যানজট কমেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাসের যাত্রী কমেছে। এতে মালিক, শ্রমিকদের আয়ও কমেছে। তিনি বলেন, আগে দিনে একটি বাস থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত জমা পাওয়া যেত। এখন আড়াই হাজার টাকার মতো পাওয়া যায়।
বাসে কত যাত্রী চলাচল করে, তা বুঝতে বিকল্প অটো সার্ভিসের পল্লবী কাউন্টার থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, গত শুক্রবার পরিবহন কোম্পানিটির ৩০টি বাস চলাচল করেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধিদের দাবি, আগে দিনে ৩৫ থেকে ৪০টি বাস চলত।
বিকল্প অটো সার্ভিসের একটি বাস গতকাল দুপুর পৌনে ১২টার দিকে যাত্রা শেষ করে মিরপুরে ফেরে। সেটির ওয়েবিলে (যাত্রীর হিসাব বিবরণী) দেখা যায়, মৎস্য ভবন এলাকায় যাত্রী ছিল ২৮ জন। আগারগাঁওয়ে ছিল ১৮ জন। বাসটিতে আসন ৩৮টি।
বিকল্প অটো সার্ভিসের পরিচালক বেলায়েত রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মালিক-শ্রমিক সবারই আয় কমেছে। কিছুদিনের মধ্যেই মালিকেরা বাস বিক্রি বা অন্য রুটে চালানোর চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য হবেন।
অবশ্য বাসে ভাড়া নির্ধারণের সময় যাত্রী ধরা হয় আসনের ৯৫ শতাংশ, যদিও মেট্রোরেল চালুর আগে গাদাগাদি করে যাত্রী নেওয়া হতো। বাসগুলো মেরামতে (রেনোভেশন) উচ্চ ব্যয় দেখানো হয়। কিন্তু বাস চলে লক্কড়ঝক্কড় অবস্থায়। মালিকেরা শ্রমিকের উৎসব ভাতাও ভাড়ার সঙ্গে আদায় করেন, যদিও তার অস্ত্বিত্ব নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে মেট্রোরেলে যাতায়াত করলে দিনে ১২০ টাকা খরচ হবে। বাসে সাধারণ ভাড়া এর অর্ধেক। শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হাফ ভাড়াও’ আছে। মেট্রোরেলে তা নেই।
যাত্রীরা বলছেন, যেসব বাস বহু আগেই সড়ক থেকে তুলে দেওয়া উচিত ছিল, সেগুলো চালিয়ে অনেক টাকা আয় করেছেন মালিকেরা। মেট্রোরেলের মতো আধুনিক গণপরিবহনের নিচে লক্কড়ঝক্কড় বাস রাখাই উচিত নয়।
মেট্রোরেল চালুর পর অবশ্য কিছু বাস ভাড়া কমিয়েছে। যেমন মতিঝিল থেকে উত্তরার আবদুল্লাহপুর পথে চলাচলকারী শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস সার্ভিস গ্রিন ঢাকা পরিবহনের হিসাবরক্ষক হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ করে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাত্রী কম পাওয়া যায়। তাই ভাড়া কমানো হয়েছে। তিনি জানান, মতিঝিল থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত বাসটির ভাড়া ছিল ১৫০ টাকা, গত ২৮ জানুয়ারি তা কমিয়ে ১২০ টাকা করা হয়েছে।
দুপুর সোয়া ১২টায় পল্লবী মেট্রোরেল স্টেশনের নিচ থেকে শিকড় পরিবহনের একটি বাসে যাত্রী হয়ে ওঠেন এই প্রতিবেদক। বাসটি যাত্রী তুলতে প্রতিটি স্টেশনেই অনেকটা সময় দাঁড়িয়েছিল। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে সেটি যখন ছাড়ে, তখন ঘড়ির কাঁটা বেলা সোয়া একটা পেরিয়েছে।
বাসটির সব আসনে যাত্রী ছিল। অবশ্য কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁওয়ে অনেক যাত্রী নেমে যান। বিজয় সরণি, খামারবাড়ির যানজট পেরিয়ে ফার্মগেট এসে বাস যাত্রীর অপেক্ষায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর ও শাহবাগে ছিল তীব্র যানজট। মৎস্য ভবন পার হয়ে হাইকোর্ট মোড় থেকেও যানজটে থেমে থেমে চলে বাস।
পল্টন মোড়ের কাছে মেট্রোরেলের সচিবালয় স্টেশন। সেখানে বাস থেকে নেমে দেখা যায়, পল্লবী থেকে পল্টন পৌঁছাতে সময় লেগেছে আড়াই ঘণ্টা। এই পথটুকু মেট্রোরেলে আসতে সময় লাগে ২৫ মিনিট। অর্থাৎ কোনো যাত্রী বাসে না এসে মেট্রোরেলে আসতে সময় বাঁচত অন্তত দুই ঘণ্টা। পল্লবী থেকে পল্টনের বাসভাড়া ৪০ টাকা। মেট্রোরেলে এই দূরত্বের ভাড়া ৭০ টাকা।
ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল পথে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেট্রোরের চলাচল শুরু হয় ২০ জানুয়ারি। এরপর মেট্রোরেলে যাত্রী বেড়েছে। বাসে এখন চলাচল করেন মূলত স্বল্প দূরত্বের যাত্রী ও স্বল্প আয়ের মানুষেরা। বাসযাত্রীরা বলছেন, মেট্রোরেলে উঠলেই ভাড়া ২০ টাকা। তাই স্বল্প দূরত্বে বাসে যাওয়াই লাভজনক। ভাড়া ১০ টাকা। আর স্বল্প আয়ের মানুষ ও শিক্ষার্থীদের একাংশ যানজটে বসে থাকতে হলেও বাসকেই বেছে নিচ্ছেন কম ভাড়ার জন্য।
মিরপুরের পল্লবীতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেট্রোরেলে যাতায়াত করলে দিনে ১২০ টাকা খরচ হবে। বাসে সাধারণ ভাড়া এর অর্ধেক। শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হাফ ভাড়াও’ আছে। মেট্রোরেলে তা নেই।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো