বর্তমান বিশ্বায়নের প্রবল স্রোতধারায় শুধু জাতি-রাষ্ট্র, জাতীয় স্বাতন্ত্র্য, জাতীয়তাবোধ যে নীরবে-নিঃশব্দে ক্ষয়ে যাচ্ছে তাই নয়, জাতীয় ভাবধারার মাধ্যমে যে ভাষা তাও ক্রমে ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নের একালে বহুজাতিক করপোরেশনের স্বার্থে বিশ্বব্যাপী এককেন্দ্রিক সংস্কৃতির বিজয় নিশ্চিত করতে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। যেহেতু সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম হলো ভাষা, তাই ভাষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। বেশ কিছু ভাষার অপমৃত্যু ঘটেছে এরই মধ্যে। ২০০১ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, বর্তমানে প্রায় ৪০ কোটি জনসমষ্টি ইংরেজিকে ব্যবহার করছে তাদের প্রথম ভাষা হিসেবে। আরো ২৫ কোটি মানুষের কাছে ইংরেজি দ্বিতীয় ভাষা। প্রায় ১০০ কোটি মানুষ এ মুহূর্তে ইংরেজি শিক্ষায় গভীরভাবে মনোযোগী। অনেকের ভবিষ্যদ্বাণী, ২০৫০ সালে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসমষ্টির ভাষা হবে ইংরেজি। বিশ্বায়নের এ যুগে বিশ্বময় যোগাযোগের মাধ্যম হয়েছে ইংরেজি। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে ইংরেজিতে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ইংরেজি। তাই আজ ইংরেজি শুধু একটি ভাষা নয়, এটি এখন এক নব্য সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এভাবে আজকের এককেন্দ্রিক বিশ্বে একদিকে যেমন বিশ্বের একক ভাষা হিসেবে ইংরেজির অবস্থান ক্রমে ক্রমে অপ্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে উঠছে, অন্যদিকে তেমনি বিশ্বের প্রায় সাত হাজার ভাষার মধ্যে প্রতি সপ্তাহে দু’টি এবং প্রতি বছরে শতাধিক ভাষা অপমৃত্যুর কবলে পড়ছে। অনেক বিজ্ঞজনের ধারণা, এই শতাব্দীর শেষ প্রান্তে বিশ্বের শতকরা ৬০ থেকে ৯০ ভাগ ভাষার ভাগ্য বিড়ম্বনা ঘটতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত সংস্থা ইউনেস্কোর অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তাই ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্টগুলোয় (বর্তমানে এই সংখ্যা ১৯৩) ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ইউনেস্কোর এ সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের একটি বিশিষ্ট অর্জন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করল এবং বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের উজ্জ্বল অধ্যায়টি বিশ্ব ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ে পরিণত হলো।
২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৯৩টি রাষ্ট্রে মাতৃভাষার দাবিতে সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার দামাল ছেলেদের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেসব তরুণের আত্মদানের কথা। পরম শ্রদ্ধা ও গর্বের সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে রফিক, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিউর রহমান, ওয়ালিউল্লাহসহ নাম না জানা আরো অনেক শহীদকে। ঢাকার শহীদ মিনার এখন শুধু ঢাকার নয়, এই শহীদ মিনার সারা বিশ্বের। হয়ে উঠেছে নতুন নতুন সংগ্রামের পবিত্র স্মারক, বিজয়ের প্রতীক, অনুপ্রেরণার উৎস। এই শহীদ মিনার এখন কম্পিত হচ্ছে দেশ-বিদেশের লাখো মানুষের পদচারণায়। আজও যারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের ভাষাকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর সংগ্রামে রত, তারা বারবার স্মরণ করবেন পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতার সংগ্রামী চেতনাকে। উদ্বুদ্ধ হবেন রক্তদানের মধ্য দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ অর্জনে। তাই এখন রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার শুধু বাংলাদেশের কৃতী সন্তান নন, তারা আজ সমগ্র বিশ্বের, যেমন ১৮৮৬ সালের পয়লা মে শিকাগো নগরীর হে মার্কেটে ৮ ঘণ্টা শ্রমকালের দাবিতে আত্মদানকারী শ্রমিকরা শেষ পর্যন্ত শুধু শিকাগো নগরীর থাকেননি। তারাও বিশ্বময় শ্রমজীবীদের প্রতিনিধিতে রূপান্তরিত হন। এদিক থেকে বলতে কোনো দ্বিধা নেই, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য এখন বিশ্বময় বিস্তৃত।
ভাষা হলো সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যম। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাহন। শিল্পকর্ম ও অগ্রগতির ধারক। ভাষার ওপর তাই কোনো আঘাত এলে সমগ্র জাতি শঙ্কিত হয়ে ওঠে। হয় আতঙ্কিত। উদ্যোগ নেয় সেই আঘাত প্রতিহত করতে। যুক্তিবুদ্ধির সহায়তায় তা সম্ভব হলে ভালো। তা না হলে অগ্রসর হয় রক্তাক্ত পথে। এগিয়ে যায় আত্মদানের পথে। পূর্ববাংলায় যে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৪৮ সালে, তার মাধ্যমে এই জাতির সংকল্পই প্রতিফলিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি এরই চ‚ড়ান্ত রূপ। একুশে ফেব্রুয়ারির জন্ম একদিনে হয়নি, হয়নি এক যুগেও। এছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষা সংরক্ষণের আন্দোলন ছিল না। ভাষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জীবনবোধ, সাহিত্য-সংস্কৃতি স্বাতন্ত্র্য, জাতির আধ্মাতিক সত্তা সংরক্ষণের সংগ্রামের মূর্ত রূপ ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের জনগণের কাছে তাই এ দিনের গুরুত্ব এমন হৃদয়গ্রাহী। একুশের সংগ্রাম একদিকে যেমন এই জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক তেমনি তার স্বপ্নসাধ পূর্ণ করার নির্দেশকও।
বিশ্বায়নের প্রবল স্রােতে যখন একটি একটি করে ভাষার অপমৃত্যু ঘটছে, তখন ওই সব ভাষাভাষী বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে। বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন তাদের শিল্প-সংস্কৃতির মূল গ্রন্থি থেকে। সাম্প্রতিককালে মৃতভাষার সারিতে এলো ম্যাসাচুসেটসের ক্যাটওয়া, আলাস্কার এয়াক, লাটভিয়ার লিভোনিয়ান প্রভৃতি। এসব ভাষা ব্যবহারকারী দেশজ সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তারা এক ধরনের যাযাবর গোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে, কেননা তারা পারবেন না বিদেশি আচার-অনুষ্ঠানকে পুরোপুরি আত্মীকরণ করতে। তাই নিজস্ব ভাষা সংরক্ষণের দাবি অনেকটা সহজাত, মৌলিক, আদিম। এ দাবি যতদিন শক্তিশালী থাকবে, একুশের প্রেরণা ততদিন থাকবে চিরঞ্জীব এবং তাও সমগ্র বিশ্বে। বাংলা ভাষা সম্পর্কে অবশ্যই নেই তেমন কোনো হতাশা। কেননা, বিশ্বায়নের একালে বাংলাভাষীদের বাংলা ছাড়াও শিখতে হবে অন্য ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজি। ইংরেজি শিখেই তীব্র প্রতিযোগিতার এই সময়ে শুধু টিকে থাকতে হবে তা নয়, বিজয়ী হতে হবে। সমানতালে পা মিলিয়ে দ্রুতগতিতে চলতে হবে। কাক্সিক্ষত লক্ষ অর্জন করতে হবে। তাই বাংলাদেশেও ইংরেজি শেখার গতি ত্বরান্বিত হবে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আকর্ষণ ইংরেজির প্রতি বৃদ্ধি পাবে ভীষণভাবে। কিন্তু সেই ঝড়ে অথবা টর্নেডোতে বাংলা ভাষা উড়ে যাবে না। ১০০ বছর পরেও বাংলা ভাষা এ দেশে প্রথম ভাষা হিসেবে টিকে না থাকলেও দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে এর স্ট্যাটাসের কোনো হেরফের হবে না। কিন্তু বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যূন ৫৭টি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর যে স্বতন্ত্র শব্দাবলি রয়েছে এবং এসব শব্দের পেছনে যে ইতিহাস রয়েছে, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠানের জীবন্ত কাহিনী রয়েছে, তার ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়ে যেতে পারে ইংরেজির ব্যাপক প্রভাবে। অথচ এই শব্দাবলি বাংলা ভাষাকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করেছে এবং ভবিষ্যতেও সমৃদ্ধ করবে ভয়ঙ্করভাবে। এ বিষয়ে এ দেশের বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীদের ভেবে দেখতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ববাংলায় যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখনো যেসব জনপদে মাতৃভাষার দাবিতে সংখ্যাহীন তরুণ-তরুণী সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন, বিশেষ করে বিশ্বায়নের এই কালে, একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাভাষীদের অহঙ্কার হয়ে না থেকে প্রতিবাদী একুশ কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানোর প্রত্যয়রূপে জাগ্রত থাকতে পারবে কী? একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস কিন্তু সাধারণ ছাত্র-জনতার ইতিহাস। এই ইতিহাসের নায়ক অথবা মহানায়ক তারাই। কোনো দল অথবা দলীয় নেতার নেতৃত্বে এর জন্ম হয়নি। দেশের চিন্তাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা তাদের যুক্তিবাদী সৃজনশীল লেখনীর দ্বারা সমাজজীবনে এর ক্ষেত্র রচনা করেন। দেশের স্বাধীনচেতা মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণরা সেই উর্বর ক্ষেত্রে রক্তবীজ বপন করেন। ফলে এই সোনালি ফসল। এই তরুণদের সংগ্রামী চেতনা সমগ্র সমাজে ছড়িয়ে পড়ে গড়ে তোলে এক অজেয় শক্তি। তাই পরবর্তী সময়ে রাজনীতিকে দান করে নতুন দ্যোতনা। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় এক নতুন চিৎশক্তি। সৃষ্টি হয় নতুন ইতিহাস। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ওই সব শহীদ এবং বীর যোদ্ধাদের যাদের রক্ত, অশ্রু ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারির মতো এই স্মরণীয় দিবসটি লাভ করেছি। এ দিনের সৃষ্টিতে তরুণরা রক্তাক্ত অবদান রাখলেও এখন তা বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক ভিসি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র: দৈনিক ইনকিলাব