ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে ঘরে রাখার প্রবণতা আবার বেড়েছে। গত ডিসেম্বরে গ্রাহকেরা ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। এসব টাকা ওই মাসে আর ব্যাংকে ফেরত আসেনি। ফলে এই টাকা রয়ে গেছে মানুষের হাতে। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকব্যবস্থার বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসভিত্তিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে ডিসেম্বরে নগদ টাকার লেনদেন বেড়ে যায়। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক মানুষ সঞ্চয় ভাঙাচ্ছেন। আবার বছরের শেষে অনেকে দেশ–বিদেশ ঘুরতে যান তাতেও নগদ টাকা বেশি খরচ হয়। আবার বিয়েশাদিসহ নানা অনুষ্ঠানও থাকে। সব মিলিয়ে তাই ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তোলা বেড়ে গেছে। এসব অর্থ কিছুদিন পর আবার বিভিন্ন হাত ঘুরে ব্যাংকে ফিরে আসবে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে খরচ করছে। সামনে মূল্যস্ফীতি কমবে, এমন সম্ভাবনাও দেখছে না। আবার অনেকে অনিশ্চয়তার কারণে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। কারণ, কিছু ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হয়েছে।
এদিকে গত জুলাইয়ে ব্যাংকঋণের সুদহারের নির্দিষ্ট সীমা তুলে নেওয়া হয়। এরপর থেকে ব্যাংকগুলো আমানতেরও সুদহার বাড়াতে শুরু করে। কিন্তু সুদ বাড়িয়েও কাঙ্ক্ষিত আমানত পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। কোনো কোনো ব্যাংক যে পরিমাণ নতুন আমানত পাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি আমানত তুলে ফেলছেন গ্রাহকেরা। আবার ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা দিয়ে ডলার কেনার কারণেও ব্যাংক খাতে টাকার টান পড়েছে। পাশাপাশি সরকারি ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। ফলে তারল্যসংকটে পড়েছে বেশির ভাগ ব্যাংক। এ সংকটে সবচেয়ে পড়েছে প্রচলিত ধারার দুটি ও শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে খরচ করছে। সামনে মূল্যস্ফীতি কমবে, এমন সম্ভাবনাও দেখছে না। আবার অনেকে অনিশ্চয়তার কারণে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। কারণ, কিছু ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হয়েছে। কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দিচ্ছে পারছে না। এ অবস্থায় অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে জমি-ফ্ল্যাটেও বিনিয়োগ করছে। এমন পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নয়।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ব্যাংক খাতের পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নিয়মকানুন পরিপালনে কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। তাতে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে, ধীরে ধীরে পুরো খাত ঠিক হয়ে আসবে।
‘ডিসেম্বরে বেশির ভাগ ঋণ পরিশোধের সময় নির্ধারণ করা থাকে। এই সময়ে অনেকে আমানত ভেঙে ঋণ পরিশোধ করে। এ জন্য আমানত তেমন বাড়েনি। এদিকে নির্বাচনের কারণে নগদ টাকার ব্যবহার অনেক বেড়ে গিয়েছিল। ব্যাংকের বাইরে টাকা বেড়ে যাওয়ার এটা একটা কারণ হতে পারে। তবে এসব টাকা আবার ব্যাংকে ফিরে আসবে।’
শাহ আলম সারওয়ার, আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাতে রাখা টাকা বাড়ল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে ছাপানো টাকার পরিমাণ (রিজার্ভ মানি) ছিল ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। নভেম্বর মাসে যা ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসেই ছাপানো টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৩১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। ছাপানো টাকার বড় অংশ থাকে মানুষের হাতে ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভল্টে। বাকি অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা থাকে।
গত ডিসেম্বরে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের ভল্টে থাকা টাকার পরিমাণ কমে গেছে। ডিসেম্বরে ২৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা ছিল বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভল্টে। গত নভেম্বরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ভল্টে ছিল ২৬ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ছিল ৯২ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা, নভেম্বরে যার পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা, নভেম্বরে যা ছিল ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত নির্বাচনের কারণে ব্যাংকব্যবস্থার বাইরে টাকার পরিমাণ বেড়েছে। প্রার্থীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই টাকা খরচ করেছেন, যা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই টাকা আবার ঘুরে ব্যাংকে আসবে। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণেও মানুষ সঞ্চয় ভাঙিয়ে দৈনন্দিন খরচ মেটাচ্ছেন। আবার ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনার কারণেও কেউ কেউ টাকা তুলে নিচ্ছেন। এখন ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ বাড়িয়ে দেওয়ায় এসব টাকা দ্রুতই ব্যাংকে ফিরে আসবে।’
পাশাপাশি সরকারি ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। ফলে তারল্যসংকটে পড়েছে বেশির ভাগ ব্যাংক। এ সংকটে সবচেয়ে পড়েছে প্রচলিত ধারার দুটি ও শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক।উচ্চ সুদেও আমানত মিলছে কম
গত জুলাইয়ে আমানত–ঋণের ৬-৯ সুদহার তুলে নিয়ে নতুন নিয়ম চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন প্রতি ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের গড় সুদহারের ভিত্তিতে ‘স্মার্ট’ সুদহার নির্ধারণ করে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্মার্ট সুদ হারের সঙ্গে বাড়তি ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ যোগ করে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে। তাতে বর্তমানে ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
ঋণের সুদ বৃদ্ধির ফলে বেড়েছে আমানতের সুদহারও। কোনো কোনো ব্যাংক ৯ শতাংশের বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। গত ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে ১৩ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। যে পরিমাণ আমানত এসেছে, তার চেয়ে ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ডিসেম্বরে ব্যাংকের ঋণ বেড়েছে ২৭ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৫৪ হাজার ২৮৭ কোটি টাকায়। অন্যদিকে নভেম্বরে ব্যাংকঋণ ছিল ১৫ লাখ ৬৪ হাজার ৬২১ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বরে বেড়ে হয় ১৫ লাখ ৯২ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। এর ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্যসংকট তৈরি হয়।
মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার পর যা আর ব্যাংকে জমা হয় না, তা-ই ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকা হিসেবে পরিচিত। এই টাকা মানুষ হয় দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে, নয়তো বেশি লাভের আশায় ব্যাংকের বাইরে বিভিন্ন সমিতি, জমি, ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ করেন। আবার কেউ কেউ টাকা তুলে ঘরেও রেখে দেন।
আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিসেম্বরে বেশির ভাগ ঋণ পরিশোধের সময় নির্ধারণ করা থাকে। এই সময়ে অনেকে আমানত ভেঙে ঋণ পরিশোধ করে। এ জন্য আমানত তেমন বাড়েনি। এদিকে নির্বাচনের কারণে নগদ টাকার ব্যবহার অনেক বেড়ে গিয়েছিল। ব্যাংকের বাইরে টাকা বেড়ে যাওয়ার এটা একটা কারণ হতে পারে। তবে এসব টাকা আবার ব্যাংকে ফিরে আসবে।’
মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার পর যা আর ব্যাংকে জমা হয় না, তা-ই ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকা হিসেবে পরিচিত। এই টাকা মানুষ হয় দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে, নয়তো বেশি লাভের আশায় ব্যাংকের বাইরে বিভিন্ন সমিতি, জমি, ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ করেন। আবার কেউ কেউ টাকা তুলে ঘরেও রেখে দেন।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো